যোগদা সৎসঙ্গ সোসাইটি অফ ইন্ডিয়ার প্রবীণ সন্ন্যাসী, আমাদের প্রিয় স্বামীজি শিবানন্দ গিরি মহারাজ জানুয়ারি মাসের ১৮ তারিখে সকাল ৬টা নাগাদ ঘুমের মধ্যেই শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন।
স্বামীজির পূর্বাশ্রমের নাম ছিল দুর্গাচরণ মাহাতো। ১৯৩৬ সালের ২০ সেপ্টেম্বর পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়া জেলার সুদূরবর্তী অঞ্চল কুলাবহালের কাছাকাছি হুলুং গ্রামে এক অত্যন্ত সাধারণ পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন।
প্রথম থেকেই তাঁর মধ্যে এক প্রবল আধ্যাত্মিক অনুরাগের স্ফুরণ দেখতে পাওয়া গিয়েছিল। অতি অল্পবয়সেই লক্ষণপুরের যোগদা সৎসঙ্গ ক্ষিরোদময়ী বিদ্যাপীঠের ছাত্র থাকাকালীন স্বামীজি আধ্যাত্মিক জীবনের সঙ্গে পরিচিত হন। গুরুদেব শ্রীশ্রী পরমহংস যোগানন্দজির দেওয়া জীবন-রূপান্তরকারী সুমহান ক্রিয়াযোগ সাধনার মধ্যে তিনি ক্রমশ নিজেকে ডুবিয়ে দিলেন।
১৯৬২ সালে মাত্র ২৬ বছর বয়সে ওয়াইএসএস-এর সন্ন্যাসী হিসেবে আধ্যাত্মিক মার্গে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে উৎসর্গ করার জন্য তিনি দৃঢ়সংকল্প করলেন। ওয়াইএসএস/এসআরএফ-এর তৃতীয় অধ্যক্ষ ও সঙ্ঘমাতা শ্রীশ্রী দয়া মাতার কাছ থেকে ১৯৬৮ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি প্রথমে ব্রহ্মচর্য এবং পরে ১৯৭২ সালের ১৪ ডিসেম্বরে সন্ন্যাস ব্রত গ্রহণ করলেন।
তিনি ছিলেন সহজসরল মানুষ। অভিমানশূন্যতা ও অকৃত্রিম সারল্য ছিল তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য যা অন্য সকলের কাছে দৃষ্টান্তস্বরূপ হয়ে থাকত। জীবনের প্রতিটি সমস্যাকে অবিচলিত স্থৈর্যের সঙ্গে গ্রহণ করার ক্ষমতা তিনি অর্জন করেছিলেন। জীবনের শেষভাগে যদিও তাঁর কিছু কিছু শারীরিক সমস্যা দেখা দিয়েছিল, কিন্তু অসাধারণ সাহস ও সহনশক্তির পরিচয় দিয়ে তিনি তার মোকাবিলা করে গেছেন।
স্বামী শিবানন্দ গিরিজি প্রথমদিকে কুলাবহাল এবং পরবর্তীকালে লক্ষণপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছিলেন। এই বিদ্যালয় দুটি বিগত ৩৭ বছর ধরে যোগদা সৎসঙ্গ সোসাইটি অফ ইন্ডিয়ার পৃষ্ঠপোষকতায় যোগদা সৎসঙ্গ শিক্ষামূলক প্রতিষ্ঠানসমূহের অন্তর্গত সংস্থা হিসেবে পরিচালিত হয়ে আসছে। তাঁর কয়েকজন প্রাক্তন সহকর্মীর স্মৃতিচারণায় জানা গেছে যে তাঁর ছাত্রদের তিনি কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতেন যাতে তারা কিছুতেই শৃঙ্খলা আর নিয়মানুবর্তিতার পথ থেকে বিচ্যুত না হয়। নানারকম খেলাধুলাতেও স্বামীজির প্রবল উৎসাহ ছিল।
কুলাবহালের মতো দারিদ্র্যপীড়িত প্রত্যন্ত অঞ্চলেও সমাজের নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর মধ্যে যাতে প্রাথমিক শিক্ষা ছড়িয়ে দেওয়া যায় যার ফলে তারা ক্রমশ উঠে এসে জাতির মূলস্রোতে অংশগ্ৰহণ করতে পারে, সে ব্যাপারে শিবানন্দজি এক মুখ্য ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত ধৈর্যশীল ও দূরদর্শিতাসম্পন্ন এক ব্যক্তি। হুলুং, হাতিবাড়ি, কুলাবহাল এবং লক্ষণপুরের মতো গ্রামগুলিতে বসবাসরত সমাজের মধ্যবর্গীয় ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠী যাতে প্রাথমিক শিক্ষার সুবিধা থেকে বঞ্চিত না হয়, তিনি তা সুনিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন।
জীবনের একেবারে প্রথমদিকেই স্বামীজি হঠযোগের প্রতি আকর্ষিত হয়েছিলেন। হঠযোগের বিভিন্ন ধরনের কঠিন আসনাদি তিনি সহজেই অভ্যাস করতে পারতেন। তিনি প্রকৃতিপ্রেমিক ছিলেন; সময় পেলেই আশ্রমসংলগ্ন উদ্যানে প্রবল উৎসাহের সঙ্গে গাছগাছালির পরিচর্যায় মেতে উঠতেন। বিকেলে উদ্যান-পরিচর্যা শেষ হয়ে গেলে তিনি প্রায়শই লক্ষণপুরের ধ্যানমন্দিরে আশ্রমের কর্মীবৃন্দদের জড়ো করতেন এবং স্বাস্থ্যরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় হঠযোগের প্রাথমিক আসনগুলো তাদের শেখাতেন।
জীবনের শেষদিন পর্যন্ত স্বামীজি নিয়মিতভাবে এবং নিষ্ঠা ও বিশ্বস্ততার সঙ্গে গুরুদেব পরমহংস যোগানন্দজি প্রদত্ত ক্রিয়াযোগ সাধনায় ব্যাপৃত ছিলেন। অন্যদের কাছে এক আদর্শস্থানীয় সন্ন্যাসজীবনের উদাহরণ তিনি রেখে গেছেন। পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়া জেলার লক্ষণপুরের ওয়াইএসএস শাখা আশ্রমে এবং কুলাবহালের ওয়াইএসএস শাখা কেন্দ্রে যোগদা সৎসঙ্গ সোসাইটি অফ ইন্ডিয়ার বিভিন্ন পদেও তিনি কর্মরত ছিলেন।
স্বামী শিবানন্দজির হাসিখুশি স্বভাব এবং নম্রপ্রকৃতির জন্য তিনি চিরকালের জন্য আমাদের মনে জায়গা করে নিয়েছেন। আত্মোপলব্ধির যে অন্তিম লক্ষ্যের পানে তিনি এগিয়ে চলেছেন, সেই যাত্রায় আসুন আমরা সবাই তাঁর প্রতি আমাদের আন্তরিক ভালোবাসা প্রেরণ করি ও তাঁর জন্য প্রার্থনায় রত হই।